জীবনের কিছু অনন্য অভিজ্ঞতা।


১/ রাবিতে ফার্স্ট ইয়ার শেষ করে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি। ডিপার্টমেন্ট এর পেছনে এক লোক ভিক্ষা করে। এক পা গোড়া থেকে কাটা, আরেক পায়ে দগদগে গ্যাংরিন, হাড় দেখা যায়, মাছি ভনভন করে। আমি, লাকি, বাপ্পি, শাপলা, শাম্মী, শবনম মিলে ঠিক করলাম এর চিকিৎসা করাতে হবে। (আমি আর শাপলা ওর দুঃখ চিন্তা করে হলের মাঠে বসে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদলাম ও।) আতিক, শফিক, জহুরুল, মাসুম, সাইফুল, অদিতি, শিমকি সক্কলেই এই উদ্যোগে অংশ নিলো। অনেকেই স্কলারশিপ এর টাকা দিয়ে দিলো আমাদের কাছে। (শুধু বায়েজিদ বলেছিলো যে টাকাগুলো ওকে দিলে ও ধূমপান করে সুখ পেতো, বায়েজিদকে আমরা ভৎসনা করেছিলাম।) রাজশাহী মেডিকেল এর একজন সার্জন এর সাথে কথা বলা হলো। তিনি বললেন যে অপারেশনে কোনো টাকা লাগবেনা, তবে মেডিসিন কিনে দিতে হবে। রক্ত জোগাড়ের দায়িত্ব নিলেন "স্বজন" এর ভাইয়ারা। আমরা ক্যাম্পাসে এবং হলে চাঁদা তুললাম। প্রায় দশ হাজার টাকা হলো। আমরা ঠিক করলাম যে বেঁচে যাওয়া টাকা দিয়ে ওকে একটা মুদির দোকান দিয়ে দেবো। স্টেশন বাজারে গিয়ে তার জন্যে লুঙ্গী এবং গেঞ্জি কেনা হলো,(আমার জীবনে সেই প্রথম নিজ হাতে কারো জন্যে লুঙ্গী কেনা, অত্যন্ত রোম্যান্টিক অনুভূতি) কারন সে বলেছিলো যে সে পুরনো কাপড় পরে হাসপাতাল যেতে চায়না। (সে লুঙ্গী গেঞ্জি সে "হারিয়ে ফেলেছে" বলে দাবি করে এবং পরেরদিনও যথারীতি ছেড়া-ময়লা কাপড় পরে আসে। আমার কাছে টাকা চায়, কিন্তু আমি দেইনি।) হাসপাতালে ভর্তি করার পর অপারেশনের আগের রাতে সে পালিয়ে যায়। হেতেম খা এলাকায় তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। তার তিন ছেলেমেয়ে। বৌ আবার প্রেগন্যান্ট। প্রতিবেশীর জবানিতে আমরা জানতে পারি যে এর আগেও মানুষ তার জন্যে অর্থ সংগ্রহ করেছে এবং সে সেই টাকা সে "হাতের তালুতে গুড়া করে নাক দিয়ে টেনে" শেষ করেছে। হেরোইনচির শরীরের ক্ষত কখনো শুকায়না।
এই লোকটা এরপরেও ক্যাম্পাসে ভিক্ষা করতো। কেউ তার চিকিৎসার অগ্রগতি জানতে চাইলে সে জানাতো যে মেয়েরা তার নামে টাকা তুলে কি করেছে সে জানেনা। তখন আমরা ভয় পেতাম যে আমরা ক্যাম্পাসে গণপিটুনি খেতে পারি। এই অবস্থায় একদিন রিপন আর রাজিব এসে লোকটাকে জানায় যে কুড়াল দিয়ে ওর পা এখনি অপারেশন করে দেওয়া হবে। সেই ভয়ে সে ক্যাম্পাসের বাইরে যেয়ে ভিক্ষা করতো।

২/ মিরপুর ১২ এর এই বাসার কাছে একজন ডাব বেঁচতো। তার মাথায় রোদ তেতে ওঠে দেখে তার জন্যে একটা লাল রঙা ক্যাপ কিনলাম। কিন্তু সে আর আসেনা। একদিন ফোন করে জানলাম যে তার "হাটের ওসুক"। ব্যক্তিগতভাবে দেখা করে একহাজার টাকা দিলাম, আর সিগারেট খেতে বারণ করলাম। সেই থেকে সে আমাকে দিনে পাঁচ-সাতবার ফোন দেয়। অফিসে এবং বাসায় ঢুকে পড়তে চায়। তার আরো পাঁচ হাজার টাকা চাই। তার দুই বৌ মিলে চারটা ছেলেমেয়ে। তার অনেক টাকা দরকার।
৩/একজন বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালা আছেন। তিনদিন অনুপস্থিত দেখে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর হয়েছিলো। তিনি জানালেন যে তিনশো টাকায় কচুক্ষেতে ভালো রেইনকোট পাওয়া যায়। তিনশো টাকা দিলাম। সেই থেকে আর কোনো বৃষ্টির দিনে তাকে দেখিনি।
৪/ রাবিতে থার্ড ইয়ারে পড়ার সময়। আমার বন্ধু তারেক ক্যাম্পাসে বেড়াতে এলো। শহীদ মিনারে আড্ডা শেষ হতে মাগরিবের আজান দিয়ে দিলো। সে আমাকে হলে রেখে আসতে চাইলো। আমরা টুকিটাকির পাশ দিয়ে ডানে মোড় নিয়ে রবীন্দ্র ভবনের বিজনেস অনুষদের গেটের সামনে দিয়ে হাটছিলাম। কারো প্রবল ফোপানির শব্দে থমকে দাঁড়ালাম। কালো অন্ধকারের মধ্যে মিশমিশে কালো এক ছেলে কাঁদছে। তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু চাঁদের আলোয় ঝলকাচ্ছে। সে চকোলেট বেঁচে। তার আশি টাকা হারিয়ে গেছে। আমরা দুই বন্ধু শেয়ার করে চল্লিশ করে মোট আশি টাকা তাকে দিলাম। দুইদিন পর দেখি সে আইন অনুষদের গেটে বসে দিনের বেলা একই ভঙ্গীতে কাঁদছে। কারন জিজ্ঞেস করলে বলে, "চকলেট বেচি, টাকা হারিয়ে গেছে।" আমি বললাম, "আশি টাকা?" সে বললো, "জি, আশি টাকা!"
৫/ রাজশাহীতে এক ডিসেম্বর মাসের কনকনে সন্ধ্যেয় আমি আর সনি এক বৃদ্ধ ভিক্ষুককে বিশাল বেকারির সামনে ঠকঠক করে কাঁপতে দেখলাম। ওখানে নিক্সন মার্কেটে একশো টাকায় সোয়েটার পাওয়া যায়। টাকাটা দিয়ে সনি এবং আমি দুজনেই অসীম সওয়াবের অধিকারী হওয়ার জন্যে লোভী হয়ে উঠলাম। তারপর সমঝোতায় দুইজনে ভাগাভাগি করে সোয়েটার কেনা হলো এবং চাচা মিয়াকে পরম মমতা ও শ্রদ্ধার সাথে হস্তান্তর করা হলো। আমরা দুজনা তারপর গেলাম বিদ্যুতে। খেয়েদেয়ে আরামে ফিরছি, মাঝে ঘন্টাখানেক পেরিয়েছে। ফেরার পথে দেখি চাচা জায়গা পালটে সেইসসময়ের প্রিতম হোটেলের সামনে এসে একই ভঙ্গিতে কাঁপছে। সোয়েটার উধাও।

No comments

বিটকয়েন - নতুন ধারা

বিটকয়েন হচ্ছে এক ধরনের সাংকেতিক মুদ্রা (Virtual Currency) যেটি ক্রিপ্টোগ্রাফিক প্রোটকলের মাধ্যমে লেনদেন করা হয়ে থাকে। এটি লেনদেন নিয়ন্ত্রণ...

Theme images by enjoynz. Powered by Blogger.